অদম্য ইকরামুল হাসান শাকিল

Spread the love

ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল পত্রিকার পাতায় ছাপার অক্ষরে নাম আসবে। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। সেজন্য প্রয়োজন ভিন্ন কিছু করার। তাই প্রথমে নিজ এলেকায় ধূমপানের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলাম। খেলাধুলাতেও পিছিয়ে ছিলাম না। দুরন্ত শৈশব বলতে যা থাকে আমার তার পুরোটাই ছিল। ২০১০ সাল থেকে পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশ এর নাট্যকর্মী হিসেবে নিয়মিত কাজ করছি। এরপর ২০১২ সালে পর্বতারোহণের ভূতটা চেপে বসল।’ নেপালের পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত বিস্তীর্ণ ‘ দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ বা বৃহত্তর হিমালয়ের দুর্গমগিরি পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন রাতের পর রাত ঘুমাতে দেয়নি গাজীপুরের ইকরামুল হাসান শাকিলকে। অবশেষে ১০৯ দিনে পর্বতের উঁচুতে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বন্ধুর পথ হেঁটে শাকিল তাঁর স্বপ্ন ছুঁইয়েছেন। এভাবেই বলতে শুরু করেন নেপালের ‘গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল’ থেকে সদ্য ঘুরে আসা বাংলাদেশি তরুণ অভিযাত্রী ইকরামুল হাসান শাকিল।

এ অভিযানে তিনি ২৯ টি দুর্গম ঝুকিপূর্ণ পর্বতের পাস অতিক্রম করেছেন যার মধ্যে ১৪টি পাস পাঁচ হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এই পথ পাড়ি দিলেন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জন্ম নেওয়া শাকিলের মাধ্যমিকের সীমা পার হতে হয় জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে। তিনি ‘বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব’-এর সদস্য হিসেবে নিয়মিত পর্বতারোহন করে যাচ্ছেন। ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহনের উপর মৌলিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পর্বতারোহণের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে এম এ মুহিতের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো যাত্রা করেন মাউন্ট কেয়াজো রি পর্বতশৃঙ্গে। সফল এ অভিযানের পর ২০১৭ সালে বেরিয়ে পড়েন ৬ হাজার ২৪৯ মিটার উচ্চতার লারকে পর্বত শিখর অভিমুখে। তবে এবারে ভাগ্য পুরোটা সহায় ছিল না। পর্বতের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছানোর আগেই আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে ওঠে। কোনোক্রমেই আর সামনে এগুনো সম্ভব হলো না। তাই মিশন অসম্পূর্ণ রেখেই নেমে আসতে হয় মাটিতে। তবে এ বিরূপ যাত্রায় উদ্যম হারাননি শাকিল।

২০১৯ সালে আবার বেরিয়ে পড়েন পর্বত গিরির দুর্গম পথে। পাঁচ দেশের আট পর্বতারোহীর এক দলের সাথে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমলুংয়ের চূড়ায় পা রাখেন। প্রশিক্ষণকালেই জয় করেন ‘দ্রৌপদী-কা-ডান্ডা-২’ শৃঙ্গ। এবার স্বপ্ন হলো আরো বিস্তৃত। লক্ষ্য স্থির করলেন জয় করবেন হিমালয়ের ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ অংশ। হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নেপালের পূর্ব থেকে পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ দুর্গম এ পথটিকে বলা হয় ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’। পৃথিবীর মাত্র ৫০ জনেরও কম অভিযাত্রী এ পথে সফলভাবে যাত্রা করেছেন। শাকিলের ১০৯ দিনের দীর্ঘ অভিযানটি শুরু হয় গত বছরের জুলাই মাসে। পহেলা আগস্ট হিলশা থেকে মূল অভিযান শুরু করে হোমলা জেলার ইয়ারি, তুমকোট, মোছু, তাপলুং, কেরমি, ধারাপুরি, সিমিকোট পার হয়ে পৌঁছে যান মোগু জেলায়। এরপর বাংলাদেশ নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ নেপাল ফ্রেন্ডশিপ অভিযানে দোগারি ও ডোলমা খাং নামের দুইটি ছয় হাজার মিটারের পর্বত অভিযানে অংশ নেন এবং ডোলমা খং পর্বতে সফল আরোহন করেন। ৪১ দিনের এ ট্রাকিং শেষে আবার গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইলের মানাসলু সার্কিট অংশে ফিরে আসেন তিনি এবং রুবি ভ্যালি শেষ করে পৌঁছে যান ল্যাংটাং অঞ্চলে। ইত্তেফাক প্রজন্মকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাকিল বলেন, ‘নেপালের সব থেকে দুর্গম ও বিপজ্জনক এ পথে ১৮টি কঠিন পর্বত পাড়ি দিয়েছি। যেগুলোর অনেকটির উচ্চতা ৫ হাজার মিটারের উপরে। এ যাত্রায় আমাকে নানা প্রতিকূলতা পোহাতে হয়েছে। আমার কোনো সঙ্গী ছিল না, একাই হেঁটেছি। কয়েকবার পথ হারিয়ে আটকে থেকেছি, শীলাপ্রপাতের মধ্যে পড়েছি, বরফগলা হিমশীতল নদী পার হয়েছি। দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ এ অভিযানের নানা বিষয় নিয়ে সমকালের মুখোমুখি হয়েছিলেন শাকিল। শোনান, বেশ কয়েকবার মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসার ভয়ংকর সব গল্পও।

 

জানালেন, নেপালের পশ্চিম প্রান্তের হিলশা সীমান্ত থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প পর্যন্ত অভিযানে বেশ কয়েকবার বিপদের মুখে পড়েও ফিরে এসেছেন। পাহাড়ের ওপরে বসবাসকারী একটি পরিবারের আতিথেয়তার কথা তিনি কখনও ভুলবেন না বলে জানালেন। শাকিল বলেন, ‘নেওয়ারি সম্প্রদায়ের এক দিদির বাসায় এক রাত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে ট্রেকিং করে সন্ধ্যার সময় যখন তাঁর বাড়িতে এসে রুম ভাড়া দেওয়ার শর্তেই উঠেছিলাম। তারপর তাদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক হয়ে গেল যে, রুম ভাড়া এবং খাবারের বিল ফ্রি করে দিলেন। ফেরার সময় সম্মান জানিয়ে গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন। আবার যেন আসি–সে কথাও বারবার বললেন দিদি। এ রকম শত শত মানুষের ভালোবাসা আর অভিজ্ঞতা আমাকে ঋণী করেছে।’ প্রথম বাংলাদেশী ও একমাত্র বাঙালি হিসেবে নেপালের গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন শাকিল। গ্রেট হিমালয় বা বৃহত্তর হিমালয় বা হিমাদ্রি হল হিমালয় রেঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট এবং অন্যান্য উচ্চ শৃঙ্গ যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে এবং নাঙ্গা পর্বত বৃহত্তর হিমালয় পর্বতের অংশ। এর মোট বিস্তৃতি ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার এবং এগুলোর গড় উচ্চতা ২০ হাজার ফুট। ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ নামে একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেপাল থেকে সীমান্ত পর্যন্ত ৯৩ জন অভিযাত্রী নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন মাত্র ৩২ জন অভিযাত্রী। সেই হিসেবে শাকিল ৩৩তম সফল অভিযাত্রী।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *