পাখিদের জীবনকথা নিয়ে দু’চার কথা

Spread the love

সাধারনত বর্ষার সময় পাখিদের গায়ে নতুন নতুন পালক গজায়। পালক বদলালে তো পাখিদের একেবারেই চেনার কোন উপায় থাকে না। বিশেষ করে বাবুই পাখি এদের তো পালক গজানোর পর চিনতে খুবই কষ্ট হবে। এ সময় মনে হয় প্রকৃতি যেন সুনিপুন হাতে পাখিদের সবকিছু বদলে দেয়। ভিন্ন রূপে আর ভিন্ন আঙ্গিকে এ সময় আবির্ভূত হয় পাখিগুলো। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে যেন পাখিদের আনন্দ থাকে, থাকে তখন আর একটি বাড়তি উত্তেজনা। এ মৌসুমেই পাখিরা ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ভাব বিনিময় করে, করে আলিঙ্গন। এ সময় দেখা যায় আর এক অভাবনীয় দৃশ্য তা হলো পাখি তাদের বাচ্চাদের পরম মমতায় খাওয়ানোর দৃশ্য ।

বর্ষার আগেই গ্রীষ্মকাল আর এ সময় থাকে বৈশাখ মাস। এ মাসেই সাধারণত পাখিদের মধ্যে যৌবন আসতে শুরু করে। তখন পাখিগুলো অস্থির হয়ে যায় জোড় বাধার জন্য। পাখির জগতের এক বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো মেয়ে পাখিদের তুলনায় পুরুষ পাখিরা দেখতে অনেক সুন্দর হয় তবুও এ সময় পুরুষ পাখিরাই মেয়ে পাখিদের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতে থাকে।

সম্ভবত পাখি, ফুল আর প্রজাপতিই বেশি আকর্ষন করে মানুষকে, ভালবাসতে শেখায় প্রকৃতিকে। পাখিদের বিচিত্র জীবনযাত্রা মানুষের কাছে চিরকালই দুর্নিবার কৌতুহলের বিষয়। কীটপতঙ্গভুক পাখি শস্যক্ষেত্র রক্ষা করতে মানুষকে সাহায্য করে, আবার কত পাখি নেপথ্যে পরাগ সংযোজন ঘটিয়ে বা বীজ ফেলে রক্ষা করে চলেছে গাছপালা। পাখিই মানুষকে শিখিয়েছে আকাশে উড়বার কৌশল। আর পরিযায়ী পাখিরা তো এক অপার বিস্ময়।

জীবনের বিচিত্র সম্ভার প্রকৃতির আঙ্গিনায় অনেক পসরা সাজিয়ে জনাবধি আকর্ষণ করে মানুষকে। সবুজের সমারোহ, নদীর তটভূমিতে অথবা দূর পাহাড়ের শীর্ষে অবাধে উড়ে বেড়ায় কত বিচিত্র রকমের পাখি। এদের কারো বৈচিত্র্য রঙের চাকচিক্যে, কারো ঝুঁটি বা বাহারী লেজে আবার কেউ বা সঙ্গীতের জগতে এক আশ্চর্য পূর্বসূরী।

আই বি এ নামে খ্যাত আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত পাখি সমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে উনিশটি এলাকা রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে। আর এর তিন ভাগের এক ভাগই রয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। এখানকার আই বি এ হলো টাঙ্গুয়ার হাওর, আইলা বিল, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর ও লাউয়াছড়া বন। এখানকার আরো অনেক বন এবং হাওর আই বি এ তালিকাভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের বামসার এলাকা আছে মাত্র দুটি। আর তা হলো- বামসার এবং সুন্দরবন।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর হলো হাকালুকি হাওর। এই হাওরে আছে ২৭৬ টি বিল। চলতি বছরের পাখিশুমারিতে দেখা গেছে শুধুমাত্র এক হাওয়া বন্যা বিলেই রয়েছে একসঙ্গে চল্লিশ হাজার পরিযায়ী হাঁস। পৃথিবীর খুব কম জায়গায় পাখিদের এ রকম মিলনমেলা চোখে পড়বে। একমাত্র বেয়ারের ভুতিহাস হাকালুকিতে ছাড়া আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। এটা আমাদের গর্বের বিষয় কারণ এ হাঁসটি সারা পৃথিবীতে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে স্বিকৃত। হাকালুকিতে গেলে দেখতে পাওয়া যায় খয়রা,চকাচকি,পাতি চকাচকি, পাতি তিলিহাঁস, নীলমাথা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ইউরেশীয় সিথিহাঁস, নাকতা হাঁস, ধলা বালিহাঁস, পিয়ং হাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তরে ল্যাঞ্জাহাঁস প্রভৃতি। সিলেটের আর একটি বিলের নাম হলো বাইক্কা বিল। এখানে গেলে দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজার কালেমের আনাগোনা।

পাখিদের মধ্যে আছে কালো তিতির। এদের এক সময় বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে দেখা পাওয়া যেত। বর্তমানে এদের দেখা পাওয়া খুবই কষ্টকর। তবুও এদের মাঝেমধ্যে দেখা পাওয়া যায় তেতুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে। তবে মজার ব্যাপার হলো যে, এ পর্যন্ত কোন ফটোগ্রাফার এ পাখিটির ছবি তুলতে পারেনি। আর তাছাড়া তেতুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে যে সমস্ত কালো তিতির দেখা যায় তাদেরকে সাধারণত স্থানীয় ভাষায় “শেখ ফরিদ” নামে ডাকা হয়। এখানকার আখক্ষেতগুলোর মধ্যে এদের দেখা পাওয়া যায়। তবে মনে হয় এখান থেকেও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এ পাখিগুলো। কালা মথুরা বাংলাদেশের আর একটি বিপন্ন প্রজাতি। এ পাখিগুলোকে দেখলে মনে হবে যেন এরা খুব অসহায়। এই কালা মথুরাকে বাংলাদেশের শেরপুর অঞ্চলে এখনও দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল, রাজশাহী, নওগাঁ, শেরপুর, প্রভৃতি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এশিয়া শাহ বুলবুলি। এ প্রজাতির পাখিটি রাজশাহী, নওগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়। চৈত্র মাসেই এদের বেশি চরে বেড়াতে দেখা যায়। এ ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায় ।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিশেষ করে যে কোনদিন ভোরবেলায় লাউয়াছড়ার বনগুলোতে শত শত প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। বনমুরগী থেকে শুরু করে ধনেশের মতো বিরল প্রজাতির পাখি দেখতে হলে সিলেটের লাউয়াছড়ার বনগুলোতে যেতে হবে। এ সমস্ত বনে গেলে দেখতে পাবেন ট্রগোন, কালা রাজা, র্যাকেট ড্রঙ্গো, মথুরা, সাতসাইলী সহ অনেক ধরনের বিপন্ন প্রজাতির পাখি। জানকিছড়া বনেও অনেক প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে নীলকান বসন্ত বৌরি, নাটাচ, মালকোয়া প্রভৃতি প্রজাতির পাখিগুলো দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় ভিনদেশী কোকিল।

বাংলাদেশে ষোল জাতের কোকিল আছে এবং মালকোয়া আছে মাত্র দুই জাতের। এদের মধ্যে আট জাতের কোকিল হলো পরিযায়ী। আর বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মতো এত পাখি বাংলাদেশের একমাত্র সুন্দরবন অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও মনে হয় দেখতে পাওয়া যাবে না। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রয়েছে নলবন, পাহাড়ী বন, সমতলীয় বন, ইন্দো-চাইনিজ সোঁদাবন, প্রাকৃতিক ঘাসবন এ ছাড়াও দেশের বৃহত্তম মিঠাপানির আধার, শত শত বিল, হাওর প্রভৃতি রয়েছে এই সিলেট অঞ্চলে। চা বাগানের জন্য বিখ্যাত এই সিলেট অঞ্চল। এখানকার চা বাগানগুলোর ফাকে ফাকে বসে থাকা বাঁশবন, ঝোপঝাড়গুলোও পাখির আবাসস্থল।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন হলো সুন্দরবন। বাংলাদেশে যত প্রজাতির পাখি আছে তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যাবে এই সুন্দরবনে। তবে বর্তমানে দিন দিন সুন্দরবন পাখি বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যাচ্ছে। তাই যদি পাখি বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য সরকারী বা বেসরকারী কোন উদ্যোগ না নেওয়া হয় তবে এখান থেকেও পাখি হারিয়ে যাবে কোন একদিন। সুন্দরবনে বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে মাছরাঙ্গা পাখি, মাস্কট ফিনফুট, মদনটাক, ছোটকেস্ট্রেল, মেটে হুতুমপেঁচাসহ অনেক বিরল প্রজাতির পাখি।

এছাড়াও বাংলাদেশের আরো অনেক অঞ্চলে পাখিদের বেশ আনাগোনা দেখা যায়। সুন্দরবনের পর এদেশের সবচেয়ে বড় হ্যাবিট্যাট রয়েছে বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগে। এসব বিভাগে রয়েছে পাহাড়ী বন, উপকূলিয় বন এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ইন্দোমালয়ী বন।

বাংলাদেশে বর্তমানে সাত জাতের টিয়া আছে তার মধ্যে চন্দনা টিয়া দেখতে খুবই সুন্দর। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের শিমুলিয়াতে এদের দেখতে পাওয়া যায়।শিমুলিয়াতে এছাড়াও কাঠশালিকের বসবাস দেখা যায়।

বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালীর বিস্তির্ণ এলাকায় রয়েছে প্রায় একশোরও বেশি চর। আর এই পুরোনো চরগুলো এখন মানুষের দখলে। এখনও মানুষের পা পড়েনি এরকম চরের সংখ্যা এখানে এখনো অনেক। যেখানে সাধারণত মানুষের পদচারণা কম সেসব এলাকায় পাখিদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়।

আমাদের দেশে প্রায় পনের জাতের গাংচিল আর পানচিলের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাখি হলো পালাসী পানচিল। এদের সাধারনত উপকূল অঞ্চল ছাড়া কোথাও দেখা যায় না, আর এ কারনেই উপকুলের মানুষ একে গাংচিল বা বড় গাংচিল নামে ডেকে থাকে ।

এবারের পাখিশুমারিতে বিগত দশ বছরের চেয়ে সবচেয়ে কম পাখির দেখা মিলেছে। এর প্রধান কারণ হলো পরিবেশ বিপর্যয়। আবার আরও একটি কারণ আছে তা হলো মানুষের অত্যাচার। এই অত্যাচারের ফলে বহু পাখি আমাদের দেশ ছেড়েছে এবং আরও পাখি দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় আছে। যেমন দেশি গাংচষা। এদেশের অতি বিপন্ন পাখির একটি জাত। এই গাংচষা দুই চারটি পাখি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা গেলেও একসাথে দুই তিন হাজার পাখির দেখা মিলবে হাতিয়ার মুক্তারিয়া চ্যানেলে। তাহলে এ থেকে বোঝা যায় যে, গাংচষা টিকে আছে বড় জোর হাজার তিনেকের মতো। নিঝুম দ্বীপ, কালকিনির চর কুকরিমুকরি, কালাসার ছড়া, খড়কির চর, কলাকাইচ্চা, সোনারূপার চর, সিপচরে এখনও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায় কারণ এখানে এখনও পাখির বসবাসের উপযোগী আছে। এখানে গেলে বিশেষ করে হাজারো রকমের পরিযায়ী হাঁস দেখতে পাওয়া যায় ।

হাজারো ওয়েডার দেখার একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা হলো সোনাদিয়ার দ্বীপ। এই সোনাদিয়ার দ্বীপেই সবচেয়ে বেশি পাখি দেখতে পাওয়া যায়। এত পাখির সম্মেলন হয়তো বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যাবে বলে আমার মনে হয় না। দীর্ঘ তের মাইলের এ দ্বীপে ভাটা নামার সাথে সাথেই বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো পাখির দেখা মিলবে। সোনাদিয়ার শেষ প্রান্ত হলো বেলেকের দিয়া গত বছর পাখিশুমারিতে প্রায় পনের হাজারেরও বেশি পাখি দেখা গিয়েছিল এই বেলেকের দিয়াতে ও আলুরদিয়াতে। তবে এ বছর এদের সংখ্যা কমে গেছে। সোনাদিয়া এখন গোটা পৃথিবীর পাখি প্রেমিকদের কাছে আলোচিত নাম। কারণ এখানে এবারই প্রথম পাওয়া গেছে সারাবিশ্বেই বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামুচঠুটো বাটান। এ দ্বীপে এখন অনেক বিদেশী পর্যটককেও দেখা যাচ্ছে পাখিটিকে এক নজর দেখার জন্য।

ছেঁড়াদিয়া তবে লোকে একে ছেঁড়া দ্বীপও বলে থাকে। এখানে খুব একটা বেশি জাতের পাখির দেখা মিলবে না। এই দ্বীপেই এ দেশের দুর্লভ পাখি শৈলবগাকে প্রায় সবসময় দেখা যায়। তবে শীতের সময় গেলে বেশি চোখে পড়বে।

বাংলাদেশে বর্তমানে দেশী ও পরিযায়ী পাখি মিলে প্রায় ৭০০ জাতের পাখি আছে। বাংলাদেশের মতো কম আয়তনের পৃথিবীর কোন দেশে এত জাতের পাখির দেখা মিলবে না।

পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন নতুন নতুন পাখিদের বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সেটা করা হলেই হয়তো বাংলার পথে ঘাটে শোনা যাবে আমাদের দেশের বর্ণিল পাখিদের মুখরিত সুরের কোলাহল । আর বন, প্রকৃতিও ফিরে পাবে চেনা সুরের ভুবন।

বি.দ্র: মধুপুর বন, সুন্দরবন, লাউয়াচড়া বন, সিতাকুণ্ড সিডার পাহাড়, হাইল হাউজ, টাঙ্গুয়া হাউড়, বাক্কা বিল ইত্যাদি সংরক্ষিত।

সুত্র: সীমান্ত দীপু, সমকাল, ঈদ আনন্দ সংখ্যা, শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *